ডাঃ মোঃ আব্দুল ফাত্তাহ
বর্তমানে বিশ্বব্যাপী নভেল করোনা (COVID-19) ভাইরাসের সংক্রমণ মহামারী আকার ধারণ করেছে। করোনা ভাইরাসের ভয়াল থাবায় বিশ্বে আক্রান্ত থেকে মৃত্যুর হার যেমন লক্ষ লক্ষ তেমনি কোটি কোটি মানুষের মৌলিক চাহিদা মেটানো কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে উঠছে। এই ভাইরাসে উন্নত রাষ্ট্র ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার সাথে নুয়ে পড়েছে ঐ সব দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরাও। যার ফলে করোনা ভাইরাস দ্বারা বৈশ্বিক বিপর্যয়ও আজ অবধারিত। বাংলাদেশেও এর ব্যতিক্রম নয় বরং ঘনবসতিপূর্ণ বিশাল জনগোষ্ঠীর এই দেশের নানান অনিয়ম,অপরিকল্পিত স্বাস্থ্য ব্যবস্থা,দারিদ্র্যতা,অর্থনৈতিকভাবে অসচ্ছল ও কর্মহীন এবং ক্ষুধার্ত মানুষের বাঁচার লড়াই দিনের পর দিন ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করছে।
ডব্লিউএইচও’র মতে সঠিক পরিকল্পনা মাফিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সাথে আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার সমন্বয়ে সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা এবং রোগ প্রতিরোধীই হল করোনা থেকে রেহাই পাওয়ার উপযুক্ত মাধ্যম। করোনা প্রতিরোধের মধ্যে অন্যতম হলো সঠিক স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা,শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা/ইমুনিটি বাড়ানো, ফুসফুসের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি,শারীরিক ক্ষমতা বা ফিটনেস যথা:স্ট্রেন্থ ও ইনড্রুরেন্স (কার্ডিও-রেসপিরেটরি ইনড্রুরেন্স) ঠিক রাখা,পরিমিত পুষ্টিকর খাবারের সঙ্গে ভিটামিন-সি ও ডি জাতীয় খাবার এবং প্রচুর পানি পান করা। সেই সাথে পর্যাপ্ত ঘুম (সুস্থ মানুষের ৭/৮ ঘন্টা) ও নিয়মিত (দৈনিক কমপক্ষে আধা ঘন্টা) শারীরিক এক্সারসাইজ বা ব্যায়াম করা।
ডব্লিউএইচও’র তথ্য বিশ্লেষণে করোনায় আক্রান্ত শতকরা ৮০-৮১% মাইল্ড বা মৃদু রোগী যাদের স্বাভাবিক চিকিৎসায় উন্নত করা সম্ভব, ১৪-১৫% সিভিয়ার বা গুরুতর আক্রান্তদের সাধারণ চিকিৎসা সাথে সাথে অক্সিজেন থেরাপির প্রয়োজন হতে পারে এবং ৫% রোগীর ভেন্টিলেশন অর্থাৎ কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাসের প্রয়োজন হয়। করোনায় আক্রান্ত রোগীর তীব্রতা ও মৃত্যুর হার (প্রায় শতকরা ৩-৫%) বয়স্কদের পাশাপাশি যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম,শ্বাস-প্রশ্বাস জনিত সমস্যা যথা;সিওপিডি,অ্যাজমা, কিডনি ফেইলর,হার্ট ফেইলর ও ডায়াবেটিস সহ গুরুতর জটিলতায় রয়েছে তাদের।
কোভিড-১৯ বা করোনা হল ফুসফুস ও শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ রোগ অর্থাৎ সরাসরি এই ভাইরাস রোগীদের শ্বাসনালী ও ফুসফুসকে আক্রান্ত করে। যার ফলে ফুসফুস ও শ্বাসনালীতে প্রচুর পরিমাণ কফ ও প্রোডাক্টিভ স্পুটাম বা শ্লেষ্মা জমে শ্বাসনালী ব্লক করে রোগীর স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাসে সমস্যা করে অর্থাৎ শ্বাসকষ্ট হয়। একটি স্বাস্থ্য নিবন্ধনে বলা হয়েছে, নোভেল করোনায় আক্রান্তদের শতকরা ৬৮% রোগীর কাশি, ৩৮% ক্লান্তি বা দুর্বলতা, ৩৪% প্রোডাক্টিভ স্পুটাম বা শ্লেষ্মা এবং ১৯% শ্বাসকষ্ট হয়ে থাকে। সে কারনে শ্বাস-প্রশ্বাস বা ফুসফুসের চিকিৎসায়; রোগীর শ্বাস-প্রশ্বাসের ধরন নিয়ন্ত্রণ, ফুসফুসের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি ও রেসপিরেটরি মাংসপেশির শক্তি বৃদ্ধিসহ কার্ডিও-রেসপিরেটরি ইনন্ড্রুরেন্স বৃদ্ধিতে ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা যেমন কার্যকরী তেমনি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা/ইমুনিটি বাড়ানো,শারীরিক কার্যক্ষমতা বা ফিটনেস;যথা: স্ট্রেন্থ ও ইন্ডুরেন্স ধরে রাখতেও ফিজিওথেরাপি চিকিৎসার গুরুত্ব অপরিসীম।
ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা বিশ্বজুড়ে প্রতিষ্ঠিত একটি আধুনিক গবেষণালব্ধ উন্নত ও স্বতন্ত্র চিকিৎসা ব্যবস্থা যেখানে একজন কোয়ালিফাইড ফিজিওথেরাপি চিকিৎসক (ফিজিওথেরাপিস্ট) স্বতন্ত্রভাবে রোগ নির্ণয়, চিকিৎসা, প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ প্রদান করে থাকেন। ইউরোপ-আমেরিকাসহ উন্নত দেশে করোনা আক্রান্ত রোগীদের ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা ব্যবস্থা প্রশংসনীয়। একজন বিশেষজ্ঞ ফিজিওথেরাপিস্ট করোনায় আক্রান্ত রোগীদের বুকের মাংসপেশীর স্ট্রেচিং ও ফুসফুসের বিভিন্ন ব্রিদিং টেকনিক, পজিশনিং,প্রশ্চারাল ড্রেনেজ এবং মেন্যুয়াল টেকনিকের মাধ্যমে ফুসফুস ও শ্বাসনালীতে জমে থাকা কফ ও স্পুটাম নিঃসরণে সহায়তা এবং শ্বাসনালী ক্লিয়ার করে স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাসে সাহায্য করে।
করোনায় আক্রান্তদের লক্ষণ ও তীব্রতার উপর ভিত্তি করে ফিজিওথেরাপিস্ট রোগীদের চিকিৎসা পরিকল্পনা ও চিকিৎসা প্রদান করে থাকেন অর্থাৎ কোভিড-১৯ পজিটিভ রোগীদের সম্পূর্ন আইসোলেশন (হাসপাতাল অথবা বাসায়) নিশ্চিত করে সাধারণ চিকিৎসার পাশাপাশি ফিজিওথেরাপি চিকিৎসার মধ্যে অ্যারোবিক এক্সারসাইজ যেমন:হাঁটাচলা, সিড়ি উঠানাম,দৌড়ানো,স্ট্যাটিক সাইকেলিং ইত্যাদি’র সাথে বুকের ও ফুসফুসের এক্সারসাইজ;যথা: বুকের মাংসপেশি স্ট্রেচিং,চেষ্ট ওয়াল ওপেনিং,ডীব ব্রিদিং এক্সারসাইজ, অ্যাক্টিভ সাইকেল অব ব্রিদিং,কাউন্ট ব্রিদিং অন্যতম। ডিপ ব্রিদিং এক্সারসাইজটি রোগীরা বসে,দাঁড়িয়ে বা শুয়েও করতে পারেন। শ্বাস-প্রশ্বাসের সাথে কফ বা কাশি থাকলে উপড় হয়ে শুয়ে ডিপ ব্রিদিং এক্সারসাইজ করলে শ্বাসনালী সুগম ও ফুসফুসের আয়তন বৃদ্ধি পায়।
আবার গুরুতর সংক্রমণে আক্রান্ত রোগীদের অক্সিজেন থেরাপির পাশাপাশি ভেন্টিলেশনের প্রয়োজন না হওয়া পর্যন্ত মৃদু শ্বাসকষ্টের জন্য দুই ঘণ্টা পর পর প্রোপার পজিশনিং( আধা শোয়া,পাশ ফিরে শোয়া,উপড় হয়ে শোয়া) করানো হয় সেই সাথে চেষ্ট ও ব্রিদিং টেকনিকের মধ্যে ব্রিদিং কন্ট্রোল এক্সারসাইজ,পার্স লিভ ব্রিদিং,হাফিং কফিং,ডায়াফ্রাম্যাটিক ও রেসপিরেটরি স্পাইরোমেট্রির পাশাপাশি বিভিন্ন ম্যানুয়াল টেকনিক;যেমন-পজিশনাল প্রশ্চারাল ড্রেনেজ, মোবিলাইজেশন, ভাইব্রেটিং,শেকিং,পার্কাসন বা ক্লাপিং’র দ্বারা ফুসফুসের লোব থেকে কফ ও স্পুটাম/শ্লেষ্মা নিঃসরণের মাধ্যমে ফুসফুস ও শ্বাসনালী পরিষ্কার করে এবং স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাস ও ফুসফুসের কার্যক্ষমতা বজায় রাখতে সহায়তা করে।
ভেন্টিলেশন অথবা আইসিইউতে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সমন্বয়ে গঠিত মাল্টিডিসিপ্লিনারি টিমের সাথে একজন ফিজিওথেরাপি চিকিৎসক রোগীর সঠিক শারীরিক অবস্থান,ফুসফুসের গুরুতর জটিলতা ও দীর্ঘদিন আইসিইউতে অবস্থান কমাতে এবং দ্রুত সুস্থ হতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকেন। ফিজিওথেরাপি চিকিৎসার মধ্যে প্রোপার পজিশনিং, পার্কাসন বা ক্লাপিং,মোবিলাইজেশন,জয়েন্ট রেঞ্জ অব মোশন এক্সরসাইজ,প্যাসিভ স্ট্রেচিং অন্যতম।
করোনায় আক্রান্তদের চিকিৎসার পাশাপাশি পরিমিত পুষ্টিকর খাবারের সঙ্গে ভিটামিন-সি ও ডি জাতীয় খাবার এবং পানি খেতে হবে। সেই সাথে বিনোদনমূলক কাজকর্ম,মেডিটেশন এবং প্রতিদিন কমপক্ষে ৩০/৪৫ মিনিট স্বাভাবিক এক্সারসাইজ বা ব্যায়াম করতে হবে। আক্রান্ত রোগী ও স্বজনদের মনস্তাত্ত্বিক চিকিৎসার মধ্যে পারিবারিক,সামাজিক ও প্রয়োজনবোধে আর্থিক সহযোগিতাও নিশ্চিত করতে হবে। করোনায় সুস্থতা পরবর্তী পুনর্বাসন সেবায় ফিজিওথেরাপি চিকিৎসার ভূমিকাও অনেক। এ পর্যায়ে ফিজিওথেরাপিস্টরা রোগীদের রেসপিরেটরি ও ফিজিক্যাল এক্সারসাইজের সঙ্গে বিভিন্ন মোবিলিটি উপকরণও প্রদান করে থাকেন।
সুস্থ বা আক্রান্ত নন এমন ব্যক্তি এবং ডায়াবেটিস রোগীদের পর্যাপ্ত ঘুম,পরিমিত খাবার,ভিটামিন-সি,ডি জাতীয় খাবার ও পানি পানের সাথে প্রতিদিন কমপক্ষে ৩০/৪৫ মিনিট স্বাভাবিক এক্সারসাইজ বা ব্যায়াম করতে হবে।আমেরিকান ডায়াবেটিক এসোসিয়েশন বলছেন প্রতিদিন কমপক্ষে ৩০ মিনিট করে সপ্তাহে ৪/৫ দিন অ্যারোবিক এক্সারসাইজ; যথা: হাঁটাচলা,সিঁড়িতে ওঠানামা,দৌড়ানো, সাইকেলিং,এবং সপ্তাহে ২/৩ সেশন স্ট্রেন্থেনিং বা রেজিস্টেন্স এক্সারসাইজ; যেমন-জিম অ্যাক্টিভিটি,পুশ আপ,ওয়েট লিফটিং করতে পারেন। ডায়াবেটিস রোগীদের এক্সারসাইজ/ব্যায়াম করার উত্তম সময় হল খাবার আধাঘন্টা পর (রমজানে ইফতারের আধাঘন্টা পর)।
করোনা পরিস্থিতিতে অন্যান্য চিকিৎসার পাশাপাশি বাত,ব্যথা,আঘাত জনিত ও অপারেশন পরবর্তী সমস্যা, প্যারালাইসিস এবং প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা সংক্রান্ত পরামর্শ ঘরে বসেই অনলাইনে পেতে পারেন।এক্ষেত্রে সিআরপি,মিরপুরের অনলাইন পেজ ও বাংলাদেশ ফিজিওথেরাপি অ্যাসোসিয়েশন( বিপিএ)’র অফিশিয়াল ওয়েবসাইটে লগইন করতে পারেন।
মহামারী করোনা থেকে রেহাই পেতে অবশ্যই বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যবিধি ও অন্যান্য বিধি নিষেধ মেনে সামাজিক বা শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে নিরাপদে ঘরে থাকতে হবে এবং জরুরী প্রয়োজনে মাস্ক ও গ্লাভস পড়ে কাজ শেষে দ্রুত বাসায় ফিরতে হবে।
বাংলাদেশ সরকারের সংশ্লিষ্ট স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় মাধ্যমে বিভিন্ন হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজে ফিজিওথেরাপি চিকিৎসকের প্রথম শ্রেণীর পদ সৃষ্টি এবং উন্নত দেশের ন্যায় বর্তমানে করোনা চিকিৎসা ব্যবস্থায় কোয়ালিফাইড ফিজিওথেরাপি চিকিৎসকদের অন্তর্ভুক্তিসহ দ্রুত বাংলাদেশ রিহ্যাবিলিটেশন কাউন্সিল আইন কার্যকরের আশা করছি।
লেখক: ডাঃ মোঃ আব্দুল ফাত্তাহ
জনস্বাস্থ্য ও ফিজিক্যাল থেরাপি বিশেষজ্ঞসিনিয়র ফিজিক্যাল থেরাপিস্টসিআরপি,মিরপুর, ঢাকা-১২০৬