অনেকেই ফিজিওথেরাপি পেশাকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের নতুন শাখা হিসেবে মনে করেন। কিন্তু, সত্যিটা হলো ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা উদ্ভবের হয় আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার পূর্বে, প্রাচীন গ্রীসে। তৎকালীন গ্রীক দার্শনিক ও বিজ্ঞানী হিপোক্রেটিস ব্যথা নিরাময়ে মুভমেন্ট ও এক্সারসাইজ এর ভূমিকা বিবৃত করেন। আরেক গ্রীক বিজ্ঞানী হেকটর চিকিৎসায় হাইড্রোথেরাপির ব্যবহার শুরু করেন ঐ সময়েই।
প্রাচীন মিসরীয়, চৈনিক, পারস্য সভ্যতায়ও এক্সারসাইজ, মাসাজ ও মুভমেন্টের গুরুত্ব আলোচিত হয়েছে। এরপর দীর্ঘসময় চিকিৎসাবিজ্ঞানের অন্যান্য শাখা সমৃদ্ধ হলেও ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা সম্পর্কিত জ্ঞান ও চর্চার পরিধি বাড়েনি।
অষ্টাদশ শতকের শুরুর দিকে সুইডিশ জিমন্যাস্টিক এর জনক স্যার ফের হেনরিক লিং এক্সারসাইজ, মাসাজ ও ম্যানিপুলেশন এর শারীরিক প্রয়োগের বিষয়ে কাজ শুরু করেন। অসুস্থ ব্যক্তিদের চিকিৎসার ক্ষেত্রে সুইডেনজুড়ে এই শতকটিতে ফিজিওথেরাপি একটি পেশা হয়ে উঠে। এর ফলশ্রুতিতে সুইডেনের ন্যাশনাল বোর্ড অব হেলথ এন্ড ওয়েলফেয়ার ফিজিওথেরাপিস্টদের রেজিষ্ট্রেশন দেয়া শুরু করে ১৮৮৭ সাল থেকে। ১৮৯৪ সালে চারজন ব্রিটিশ নার্স গঠন করেন ‘চার্টার্ড সোসাইটি অব ফিজিওথেরাপি’।
বিংশ শতাব্দীতে নিউজিল্যান্ডে ফিজিওথেরাপি স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯১৮ তে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্রে ম্যারি ম্যাকমিলান এবং কানাডায় এডিন গর্ডন গ্রাহাম ফিজিওথেরাপি শিক্ষাক্রম তৈরী, পেশাজীবি সংগঠন গঠন ও চর্চার ক্ষেত্রে ব্যাপক ভূমিকা রাখেন। ১৯২০ সালে বৈশ্বিকভাবে পোলিও সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ায় ফিজিওথেরাপি পেশার গুরুত্ব আরও বেড়ে যায়। একই সাথে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পর্যন্ত যুদ্ধাহত সৈনিকদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনে প্রাইভেট ফিজিওথেরাপি ক্লিনিকও চালু হতে থাকে।
পঞ্চাশের দশকে জার্মান ফিজিওথেরাপিস্ট বার্থা বোবাথ নিউরোলোজিক্যাল রিহ্যাবিলিটেশনে তাঁর বিখ্যাত বোবাথ কনসেপ্ট নিয়ে আসার পর বিশ্বব্যাপী ফিজিওথেরাপিস্টদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের ব্যাপ্তি বৃদ্ধি পায়।
৫০ এর দশকে অর্থোপেডিক মেডিসিনের জনক স্যার জেমস সিরিয়্যাক্স সফট টিস্যু ডায়াগনোসিস ও চিকিৎসা পদ্ধতির নতুন শাখা সূচনা করেন। এ সময় অস্ট্রেলিয়ান ফিজিওথেরাপিস্ট জিওফ্রে ডগলাস মেইটল্যান্ড, প্রফেসর সিরিয়্যাক্সের সাথে সাক্ষাত করেন এবং নিজেদের অর্জিত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা বিনিময় করেন।
এরপর রবিন ম্যাকেঞ্জি স্পাইনাল ডিসঅর্ডারে নিজস্ব থিওরি নিয়ে আসেন। ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা সমৃদ্ধ হয় এতে। ব্রায়ান মালিগানও নিজস্ব কনসেপ্ট এনে পেশাকে তথা অর্থোপেডিক ম্যানুয়াল থেরাপিকে করেছেন সমৃদ্ধ।
১৯৭৪ সালে গঠন হয় আন্তর্জাতিক ম্যানিপুলেটিভ অর্থোপেডিক থেরাপির সংস্থা। এর সাথে সাথে ইলেক্ট্রোথেরাপি ফিজিওথেরাপি চিকিৎসায় একটি গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসা হিসেবে অন্তভূক্ত হয়।
এরপর গবেষণা, চর্চা মাধ্যমে গত চার দশকে ফিজিওথেরাপি পেশা সমৃদ্ধ থেকে সমৃদ্ধতর হয়েছে। ফিজিওথেরাপি চিকিৎসার বিভিন্ন সাব সেক্টর যথা- অর্থোপেডিক, নিউরো, স্পোর্টস, কার্ডিওপালমোনারি, জেরিয়্যাট্রিক শাখা সন্নিবেশিত হয়েছে জোরালোভাবে।
বর্তমানে ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় চিকিৎসা ব্যবস্থা। প্রতিনিয়ত গবেষণা ও চর্চা এটিকে আরও এগিয়ে নিয়ে চলেছে। মানুষের স্বাস্থ্যসেবার গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসা পদ্ধতি বর্তমানে- ফিজিওথেরাপি!
লেখা সংকলনেঃ
ডা. মনিরুজ্জামান অলিভ
ফিজিওথেরাপি চিকিৎসক
প্রতিষ্ঠাতা, স্যার ফের হেনরিক লিং ফিজিওথেরাপি আর্কাইভ ও মিউজিয়াম