এহসানুর রহমান:
রেস্পিরেটরি ফিজিওথেরাপি হচ্ছে ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা পদ্ধতির এক বিশেষায়িত অংশ যা ফুসফুসের বিভিন্ন রকমের রোগের জটিলতা কমাতে ও শ্বাস-প্রশ্বাস নেয়ার কষ্ট কমাতে পারে। এতে রয়েছে বিভিন্ন রকমের পজিশনিং টেকনিক, চেস্টপেইন ম্যানেজমেন্ট টেকনিক, এয়ার ওয়ে ক্লিয়ারেন্স টেকনিক, ব্রিদিং এক্সারসাইজ, কন্ট্রোল্ড ব্রিদিং এক্সারসাইজ, রেস্পিরেটরি মাসল স্ট্রেন্দেনিংইত্যাদি।
বিভিন্ন দেশে রেস্পিরেটরি ফিজিওথেরাপিস্টরা চিকিৎসা দিচ্ছেন, বিভিন্ন অবস্ট্রাক্টিভ এবং রেস্ট্রিকটিভ (সিওপিডি, ব্রংকিয়েকটেসিস, এজমা) রোগের কাউন্সিলিং করছেন এবং রোগের অবস্থা সম্পর্কে রোগীদের জানাচ্ছেন।
যেহেতু করোনা ভাইরাস মানুষের দেহে প্রবেশের পর শ্বাসতন্ত্রে সংক্রমণ করে কোভিড-১৯ রোগ সৃষ্টি করছে, তাই এই রোগের সাথে সাথে স্বতস্ফূর্তভাবে শ্বাসতন্ত্রের জটিলতা তথা নিউমোনিয়া, প্রচন্ড শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি উপসর্গ দেখা দিচ্ছে। শ্বাসকষ্ট কমানোর জন্য রেস্পিরেটরি ফিজিওথেরাপিস্টra রোগীকে পজিশনিং করানো যেমন উপুড় করে শোয়ানো, ডান কাত করে শোয়ানো, আধশোয়া ইত্যাদির পরামর্শ দিয়ে ফুসফুসে বাতাস প্রবেশের পথ সুগম করেছেন। রোগীদের অবস্থা অনুযায়ী পোসচারাল ড্রেনেজ টেকনিক যেমন ক্ল্যাপিং (চিত্র-১), শেকিং, ভাইব্রেটিং ইত্যাদি ব্যবহার করে বুকে জমে থাকা কফ বের করতে সহায়তা করেন এবং এর ফলে সংক্রমণের মাত্রা কমে আসবে। ওষুধ গ্রহণের পাশাপাশি ডিপ ব্রিদিং এক্সারসাইজ, কন্ট্রোল্ড ব্রিদিং এক্সারসাইজ, পারস লিপ ব্রিদিং, ইন্সপাইরেটরি মাসল ট্রেনিং, ইন্টারকোস্টাল মাসল স্ট্রেচিং, হাফিং ইত্যাদি থেরাপিউটিক এক্সারসাইজের দ্বারা রোগীর শ্বাসতন্ত্রের জটিলতা কমানো যায়। একজন দক্ষ রেস্পিরেটরি ফিজিওথেরাপিস্টের মূল লক্ষ্য থাকে রোগীকে মেকানিকাল ভেন্টিলেশনে যাবার পূর্বেই তার শ্বাসতন্ত্রকে শক্তিশালী করে তোলা এবং যারা ভেন্টিলেশনে আছেন তাদের দ্রুত উইনিং প্রক্রিয়ায় নিয়ে যাওয়া, যাতে ভেন্টিলেটরের উপর নির্ভরশীলতা কমে যায়।
আমেরিকার ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডা. তাসবিরুল ইসলাম কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত দুর্বল রোগীদের চিকিৎসায় ফিজিওথেরাপি চিকিৎসার গুরুত্বের কথা বলেছেন।
উন্নত বিশ্বে রেস্পিরেটরি ফিজিওথেরাপিস্টরা চেস্ট মেডিসিন ওয়ার্ডে, আইসিইউতে, ফুসফুসের সার্জারির আগে ও পরে এবং রোগীর প্রয়োজন অনুসারে মাল্টিডিসিপ্লিনারি টিমে পালমোনারি বা রেস্পিরেটরি পুনর্বাসন সম্পন্ন করতে নিয়োজিত থাকেন।
ইতালির মিলান শহরের গ্রেট মেট্রোপলিটন হাসপাতালে কর্মরত অভিজ্ঞ ফিজিওথেরাপিস্ট মারতা ল্যাজেরই কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত রোগীর ফুসফুসের চিকিৎসায় রেস্পিরেটরি ফিজিওথেরাপির গুরুত্ব আরোপ করে বলেন, এ রোগীদের প্রচণ্ড রকমের নিউমোনিয়া হতে পারে যার পাশাপাশি শ্বাসকষ্ট এবং ফুসফুসে অক্সিজেনের প্রবাহে সমস্যার সৃষ্টি হয়ে রোগীর এআরডিএস (একিউট রেস্পিরেটরি ডিসট্রেস সিন্ড্রোম) হতে পারে। এর ফলে রোগীকে জরুরিভিত্তিতে হাই ফ্লো অক্সিজেন থেরাপির পাশাপাশি সিকেপ (কনটিনিউয়াস পজিটিভ এয়ারওয়ে প্রেসার) এ রাখতে হবে। তিনি বলেন, এসব কিছু একজন রেস্পিরেটরি ফিজিওথেরাপিস্টের সার্বক্ষণিক তত্ত্বাবধানে করা হয়। রোগীর এয়ারওয়ে সচল রাখা এবং শ্বাসকষ্ট নিরাময়ে রোগীকে ব্রিদিং এক্সারসাইজ করানো এবং পোসচারাল ড্রেনেজ প্রক্রিয়া ব্যবহারের কথাও বলেছেন এই বিশেষজ্ঞ রেস্পিরেটরিফিজিওথেরাপি চিকিৎসক।
মিসেস র্যাচেল কোলক্লহ, যুক্তরাজ্যের চার্টার্ড রেস্পিরেটরি ফিজিওথেরাপি অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি এবং বারমিংহাম কুইন এলিজাবেথ হাসপাতালে কর্মরত একজন ফিজিওথেরাপিস্ট, সম্প্রতি স্কাই নিউজকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর আইসিইউ সেবায় একজন ফিজিওথেরাপিস্টের ভূমিকা সম্পর্কে বলতে গিয়ে উল্লেখ করেন, “আইসিইউতে আমাদের কাজ হলো, রোগীর ফুসফুসকে সাহায্য করা এবং এর ভিতরকার শ্লেষ্মাগুলোকে বাহিরে বের করে দিয়ে ফুসফুসে বাতাস চলাচলের পথকে সচল রাখা। এটা করার জন্য আমরা হাতের কিছু কৌশলের আশ্রয় নেই যেমন, ভাইব্রেশন বা অ্যাসিসটিভ কফ টেকনিক যা বাতাস চলাচলের পথ থেকে শ্লেষ্মা সরাতে সাহায্য করে।”
কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় এই যে, এখনো পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি স্বীকৃত এই ফিজিওথেরাপি চিকিৎসার গুরুত্ব আমাদের দেশে অনুধাবিত হয় নি এবং স্বাস্থ্য কাঠামোতে দক্ষ ফিজিওথেরাপিস্টদের সংযোজন হয় নি।
ক্যাপশন(১): পোসচারাল ড্রেইনেজ এক্ল্যাপিং টেকনিক।
পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের মুম্বাইয়ে অবস্থিত টোপিওয়ালা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজের সহকারী অধ্যাপক এবং রেস্পিরেটরি ফিজিওথেরাপি বিশেষজ্ঞ ডা. রচনা অরোরা জানিয়েছেন যে সাম্প্রতিক সময়ে কোভিড-১৯ শ্বাসকষ্টের জটিলতা কমাতে ফিজিও থেরাপি দিয়ে আসছেন।
এছাড়াও সিওপিডি, রেস্পিরেটরি ফেইলুর অথবা আইসিইউতে শ্বাসকষ্টের যেসব রোগীরা ভর্তি থাকে তাদের শ্বাসপ্রশ্বাস নেয়া এবং ভেন্টিলেশনে যারা আছেন তাদের দ্রুত উইনিং প্রক্রিয়ায় নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রেও রেস্পিরেটরি ফিজিও থেরাপিস্টের অগ্রণী ভূমিকা রয়েছে।
কিছু কিছু রোগ যেমন সিওপিডি, ব্রংকিয়েকটেসিস, এজমা ইত্যাদির ক্ষেত্রে রোগীদের সব সময় ওষুধের পাশাপাশি রেস্পিরেটরি ফিজিও থেরাপি প্রয়োজন।যেসব সহজ-সরল এবং দরিদ্র রোগীরা সরকারি হাসপাতালে ভর্তি আছেন তাদের জন্য ফুসফুসে বাতাস নেয়ার বিভিন্ন প্রক্রিয়া এবং তা ধরে রাখার প্রয়োজনীয়তা সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করার জন্য রেস্পিরেটরি ফিজিওথেরাপিস্টই দরকার। কেননা একজন রেস্পিরেটরি পেশাজীবীর কাজ অন্যপেশাজীবী দ্বারা কখনোই করা সম্ভব নয়। হাসপাতালে বা বাসায় বয়স্ক রোগীরা (৬০-৮০বছর) পালস অক্সিমিটারের সাহায্যে অক্সিজেনের স্যাচুরেশন হার দেখতে পারেন, এটি যখন ৯১-৯৩।শতাংশ থাকে তখন বিভিন্ন একটিভ এক্সারসাইজের মাধ্যমে যেমন হাটাচলা, উঠা-বসা, ফ্রী হ্যান্ড এক্সার্সাইজ করে এই হার স্বাভাবিক নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন। একজন দক্ষ ফিজিওথেরাপিস্টই নির্ধারণ করতে পারেন যে কখন কোন পর্যায়ে এই ধরনের পরামর্শ দিবেন।