কাঁধের অস্থিসন্ধি মানবদেহের একটি অত্যন্ত জটিল অস্থিসন্ধি। প্রতিদিন একই রকম কাজ বারবার করাতে কাঁধের মাংসপেশিতে ব্যথা হয়। শোল্ডার জয়েন্ট বা কাঁধের অস্থিসন্ধির দুটি গুরুত্বপূর্ণ রোগ হলো ফ্রোজেন শোল্ডার ও সুপ্রাস্পাইনাটাস টেন্ডিনাইটিস। ড. অমর রঙ্গন ২০১৫ সালে প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রে উল্লেখ করেন, কাঁধের সমস্যাজনিত কারণ নিয়ে প্রতিবছর ইংল্যান্ডে মোট রোগীর ২ দশমিক ৪ শতাংশ এবং আমেরিকায় বছরে প্রায় ৪৫ লাখ মানুষ ফিজিওথেরাপিস্টের শরণাপন্ন হন। উচ্চতর গবেষণায় দেখা গেছে, গোটা বিশ্বে প্রায় ২-৩ শতাংশ রোগী ফ্রোজেন শোল্ডারে আক্রান্ত এবং এটা সাধারণত হয় ৪০-৭০ বছর বয়সের মধ্যে। আমাদের দেশে যাঁদের বয়স ৫০ এবং ৬০–এর মাঝামাঝি তাঁরা বেশি এ রোগে আক্রান্ত হন। আসুন এবার জেনে নেওয়া যাক ফ্রোজেন শোল্ডার ও সুপ্রাস্পাইনাটাস টেন্ডিনাইটিস কী এবং আধুনিক ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা ব্যবস্থাপত্র।
ফ্রোজেন শোল্ডার ও সুপ্রাস্পাইনাটাস টেন্ডিনাইটিস কী?
কাঁধের জয়েন্টটি একটি ক্যাপসুল দ্বারা আবদ্ধ থাকে। ক্যাপসুলটি সাধারণত খুব নমনীয় হয় এবং আপনার হাত নাড়াচাড়া করার সঙ্গে সঙ্গে এটিও অবাধে চলাচল করে। যখন ক্যাপসুলটিতে ইনফ্লামেশন বা প্রদাহ হয়ে তা স্ফীত বা শুকিয়ে যায়, তখনই কাঁধের জয়েন্টে ব্যথা এবং কাঁধ নাড়াচাড়ায় সমস্যা ঘটায়। এটাকে ফ্রোজেন শোল্ডার বলা হয়। এ ক্ষেত্রে কাঁধের ক্যাপসুলের প্রদাহের জন্য মুভমেন্ট কমে যায় এবং আশপাশের মাংসপেশি শক্ত হয়ে যাওয়ার জন্য ব্যথা হয়ে থাকে।
অন্য দিকে কাঁধের রোটেটর কাফ মাংসপেশিগুলোর মধ্যে সুপ্রাস্পাইনাটাস টেন্ডনে প্রদাহ হলে সেটাকে সুপ্রাস্পাইনাটাস টেন্ডিনাইটিস বলা হয়। সুপ্রাস্পাইনাটাস টেন্ডনে সৃষ্ট ক্ষত থেকেই মূলত সুপ্রাস্পাইনাটাস টেন্ডিনাইটিসের সৃষ্টি এবং এর উৎপত্তিস্থল হলো স্কেপুলার এক্রমিওন প্রসেসের নিচে এবং কাঁধের বার্সার ওপরে। বাংলাদেশে কাঁধের ব্যথার রোগীদের যথাযথ চিকিৎসা হয় না। প্রণালিবদ্ধ ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা না পাওয়ার ফলে টেন্ডনের কোলাজেন টিস্যু চিকন হয়ে যায় এবং বারবার একই কাজ করার কারণে আবার টেন্ডনে দীর্ঘস্থায়ী যে ক্ষত সৃষ্টি হয়, যাকে বলা হয় টেনডিনোসিস।
কারা ঝুঁকিতে রয়েছেন?
যেসব রোগী কাঁধে চোট পেয়েছিলেন, কিন্তু সঠিক চিকিৎসা পাননি, তাঁদের পরবর্তী সময়ে এ রোগগুলো হতে পারে। যাঁরা লেখালেখির কাজ করেন, যেমন, শিক্ষক, ডাক্তার, যাঁরা কম্পিউটারে টাইপের কাজ করেন তাঁদের সুপ্রাস্পাইনাটাস টেন্ডিনাইটিস হওয়ার আশঙ্কা বেশি। ডায়াবেটিস রোগী ও হৃদ্রোগীদের ক্ষেত্রে ফ্রোজেন শোল্ডার রোগটি হওয়ার প্রবণতা বেশি। একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, যারা ডায়াবেটিস রোগী তাদের এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় ১০-২০ শতাংশ, যেখানে সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে তা মাত্র ২-৫ শতাংশ। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ফ্রোজেন শোল্ডার ৪০ বছর বয়সের ওপরে হলেও সুপ্রাস্পাইনাটাস টেন্ডিনাইটিস যেকোনো বয়সে হতে পারে।
শনাক্তকরণ
ফ্রোজেন শোল্ডারে আক্রান্ত রোগীদের ক্ষেত্রে এক্স–রে বা এমআরআই করে ক্যাপসুলে প্রদাহের কোনো লক্ষণ পাওয়া যায় না। এ ক্ষেত্রে একজন ফিজিওথেরাপিস্ট রোগীর শারীরিক পরীক্ষা ‘এলএএম’ বা ল্যাম টেস্ট করে রোগ নির্ণয় করতে পারেন। এই টেস্টে রোগীর কাঁধের বাইরের দিকে ঘোরানো, বাইরের দিকে হাত ওঠানো এবং ভেতরের দিকে ঘোরানো—এসব মুভমেন্ট বাধাগ্রস্ত হয় ও ব্যথা অনুভূত হয়। একইভাবে, সুপ্রাস্পাইনাটাস টেন্ডিনাইটিস নির্ণয়ের জন্য রেসিস্টেড সোল্ডার এবডাকশন বা বাধার বিপরীতে বাহুকে বাইরের দিকে তুলতে বলা হয়। ১৫ ডিগ্রি রেঞ্জে ব্যথা অনুভূত হলে টেস্ট পজিটিভ হয়। এমআরআই করেও টেন্ডিনাইটিস আছে কি না, তা নিশ্চিত হওয়া যায়।
একজন রোগী কী কী সমস্যার সম্মুখীন হতে পারেন?
হঠাৎ করে কাঁধে গুলিবিদ্ধ হওয়ার মতো প্রচণ্ড ব্যথা অনুভূত হবে। ব্যথা কাঁধ থেকে আস্তে আস্তে বাহু, হাত ও কবজি পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়তে পারে। হাত মাথার ওপর তুলতে গেলে কাঁধে ব্যথা অনুভূত হবে। দৈনন্দিন জীবনের কাজকর্ম, যেমন, বোতলের মুখ খোলা, সোফার কুশন তোলার ক্ষেত্রে মনে হবে যেন কাঁধটি জ্যাম হয়ে গেছে। রাতের বেলা ব্যথার পরিমাণ এত বাড়বে যে কারণে রোগীর ঘুম ভেঙে যাবে।
জেনে নিন থেরাপিউটিক এক্সারসাইজগুলো
একজন রোগী ঘরে বসেই করতে পারবেন কাঁধের থেরাপিউটিক এক্সারসাইজগুলো। ফ্রোজেন শোল্ডার রোগীদের জন্য দেওয়া এক্সারসাইজগুলোর মধ্যে হাত পিঠের পেছনে রাখা, হাত ঘাড়ের পেছনে রাখা, ক্রস বডি স্ট্রেচিং, আঙুল দিয়ে দেয়াল স্পর্শ করে ওপরে ওঠানামা গুরুত্বপূর্ণ। হাত পিঠের পেছনে রেখে করা এক্সারসাইজের ক্ষেত্রে যদি অপর পাশের হাতের আঙুলের নাগাল না পান, তাহলে তোয়ালের সাহায্য নিয়ে সাবধানতার সঙ্গে এক্সারসাইজটি করবেন।
সুপ্রাস্পাইনাটাস টেন্ডিনাইটিসের জন্য উল্লেখযোগ্য এক্সারসাইজগুলো হলো পেন্ডুলাম এক্সারসাইজ ও ট্র্যাপ ফ্লাই। পেন্ডুলাম এক্সারসাইজটি করার নিয়ম হলো প্রথমে সামনের দিকে উপুড় হয়ে ঝুঁকে কাঁধকে শিথিল করে হাত পুরোপুরি ছেড়ে দিন। এখন হাত দিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে একটা বৃত্ত বানানোর চেষ্টা করবেন, কিন্তু এটা কখনোই বল প্রয়োগের মাধ্যমে করবেন না। এভাবে ঘড়ির কাঁটার দিকে ১০ বার এবং একইভাবে বিপরীত দিকে ১০ বার করবেন। ব্যথা ভালো হতে থাকলে ধীরে ধীরে বৃত্তের পরিধি বাড়িয়ে নেবেন এবং পরবর্তী সময়ে ভারী কোনো বস্তু দিয়ে এক্সারসাইজটি করবেন। রোগী তাঁর ক্ষমতা অনুযায়ী প্রতিদিন পাঁচ বেলা ১০-২০ বার করে এক্সারসাইজগুলো করবেন। যেহেতু সুপ্রাস্পাইনাটাস টেন্ডিনাইটিসের ৩টি পর্যায় রয়েছে, তাই এর ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা দীর্ঘমেয়াদি হয়ে থাকে। যদি টেন্ডন আংশিক বা অসম্পূর্ণভাবে ছিঁড়ে যায়, তবে পুরোপুরি ঠিক হতে দুই বছর সময় লাগে। অন্যদিকে যদি সম্পূর্ণভাবে ছিঁড়ে যায়, তবে অপারেশন–পরবর্তী ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা নিতে হবে।
মূলত ফ্রোজেন শোল্ডার রোগটি আধুনিক ফিজিওথেরাপি চিকিৎসায় তিন-চার মাসে অনেকটা ভালো হয়ে যায়, বিলম্বিত হয় ডায়াবেটিস থাকলে। কিন্তু সুপ্রাস্পাইনাটাস টেন্ডিনাইটিসের ক্ষেত্রে পুরোপুরি ভালো হওয়ার মূল শর্ত হলো কাঁধের পেশিকে বিশ্রাম, লেখালেখি ও যেকোনো ওজন তোলা থেকে বিরত থাকা, ফিজিওথেরাপিস্টের পরামর্শমতো চলা এবং দৈনিক পেশির সংকোচন, প্রসারণ করা, ঐচ্ছিক নিয়মে বাহুকে তোলা, স্ক্যাপুলার স্ট্রেচিং এক্সারসাইজ, মাংসপেশির অস্বাভাবিক সংকোচন কমাতে মায়োফেসিয়াল রিলিজ করা ও উল্লিখিত নিয়ম মেনে চলা।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, বাংলাদেশ হেলথ প্রফেশনস ইনস্টিটিউট, সিআরপি, সাভার, ঢাকা।